ঢাকা-অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক ও উন্নয়নকর্মীরা মনে করেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে দাঁড়িয়েও বাংলাদেশের সামনে এখনো বড় সংকট গণতন্ত্র পুনর্গঠন, মতপ্রকাশে বাধা ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা।
‘৫০ বছরে বাংলাদেশ: ফিরে দেখা ও ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট ও মিত্তাল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে অনলাইনে দুই দিনের সম্মেলনের প্রথম দিন গতকাল বুধবার বক্তাদের আলোচনায় এসব মত উঠে আসে।
সম্মেলনে মূলত বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং বর্তমান সময় ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোকপাত করা হয়। আলোচনায় দেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়ন এবং দেশের অগ্রগতিতে সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
সংবিধানের মূলনীতির ভাঙাগড়া ও পুনর্গঠন
রওনক জাহান বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় দেশের স্থিতিশীলতার বিষয়ে অনেকের মনে সন্দেহ ছিল, বিশেষ করে দেশের বাইরে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, কয়েক মাসের মধ্যে দেশ স্থিতিশীলতা অর্জন করল। সেই সঙ্গে দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মধ্যে দেশের সংবিধান রচিত হয় এবং চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে সামনে নিয়ে এগোতে থাকে।

দেশে মাত্র চারটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে
রেহমান সোবহান বলেন, আশির দশকের শুরুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা এবং নিহত জেনারেলের স্ত্রীর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাবা হয়েছিল, একটি গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের সূত্রপাত হলো কি না! এরশাদ সরকারের পতনের পর মনে করা হয়েছিল, দ্বিতীয় যুদ্ধজয়।
সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা বিশাল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তিনি। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল যে মুখোমুখি অবস্থানে পৌঁছেছে, অনেকটা যেন তাদের বিরোধ হুতু আর তুতসিদের মতো। এটা সংসদীয় ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এটা একটা গুরুতর চ্যালেঞ্জ।
তবে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দেশে চারটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে মনে করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ সালের নির্বাচন এবং ২০০৮ সালের সেনা–সমর্থিত সরকারের অধীনে নির্বাচন ছিল সর্বশেষ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এই নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এরপর যেসব নির্বাচন হয়েছিল, সেগুলোকে বলা যায়, নন-ইলেকশন। কারণ, সেসব অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছিল না, সেখানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
রেহমান সোবহান আরও বলেন, ৫০ বছর চলে গেছে, একটি কার্যকর নির্বাচনব্যবস্থা গঠন করা যায়নি। সংসদও অকার্যকর, যেখানে কারও জবাবদিহির ব্যাপার নেই।
রেহমান সোবহান তাঁর বক্তৃতায় সংসদে ব্যবসায়িক শ্রেণির আধিপত্যের কথাও তুলে ধরেন। তিনি এ–ও বলেন, সংসদ সদস্যরা তাঁদের অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে সাংসদ পদ ব্যবহার করেন এবং তাঁরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া এলিট শ্রেণি ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করার রীতি চালু করেছে। তিনি বলেন, পুঁজিবাদের অর্থনীতি থেকে এলিট শ্রেণি সুবিধা পেয়েছে। তারা প্রচুর অর্থসম্পদ স্থানান্তর করেছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার করা দরকার
রওনক জাহান মনে করেন, সবার আগে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। এ সময় তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, গণমাধ্যম যে ভূমিকা পালন করছিল, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনসহ অন্যান্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। সুশীল সমাজও নিজেদের মতামত প্রকাশ করে যাচ্ছিল। কিন্তু সরকার এমন কিছু আইন করেছে, যার মাধ্যমে তারা মিডিয়াকে শৃঙ্খলিত করতে চায়।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় অনেকে উদ্বিগ্ন বলে উল্লেখ করেন রওনক জাহান। মানবাধিকার কমিশনকে আরও সক্রিয় করা দরকার, যা সাধারণ মানুষও চায়।
তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উদীয়মান অর্থনীতি
গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, একটা সময় বাংলাদেশকে দুর্যোগের শিকার ভুক্তভোগী মনে করা হতো। সে অবস্থান থেকে দেশ এখন দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম হয়েছে। তিনি মনে করেন, বিনিয়োগ ও সুশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চীনের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লিংকন চেনের সঞ্চালনায় এই পর্বে আলোচনায় আশির দশকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সফলতার কথা উঠে আসে। এর মাধ্যমে জন্মহার কমায় নারীদের কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এসেছে বলে উল্লেখ করা হয়।
পপুলেশন কাউন্সিলের সাজেদা আমিন বলেন, আশির দশকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ফলাফল খুব ইতিবাচক ছিল। তবে নব্বইয়ের দশক ছিল খুব জটিল। সে সময় শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। নারীশিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাঁর মতে, বড় সমস্যা মেয়েদের ওপর যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা। এ ছাড়া এশিয়াজুড়ে প্রকট বাল্যবিবাহ সমস্যা বাংলাদেশে এখনো আছে। সেদিকে নিরাপত্তা বিধানের কথাও ভাবার ওপর জোর দেন তিনি।

আইএমএফের পক্ষে ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে প্রবাসী আয়, তৈরি পোশাকশিল্প ও কৃষি খাত যে ভূমিকা রেখেছে, ৫০ বছর পর আমরা নতুন কী করতে পেরেছি? তাঁর মতে, পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হবে নতুন বৈচিত্র্য বের করে আনা।’
মানবসম্পদের উন্নয়ন
এই পর্বে আলোচনার সমন্বয় করেন হার্ভার্ড টিএইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের রিচার্ড ক্যাশ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ বলেন, শিক্ষা খাতে সার্বিকভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি একটি সমস্যা। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা মূলত সরকারি হওয়ায় নজরদারি রয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব থাকে, যা শিক্ষার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ আরও বলেন, কম মজুরি দেওয়া হয় যেসব খাতে (পোশাক, অদক্ষ প্রবাসী শ্রমিক), সেগুলোতে দেশ উন্নতি করেছে। কিন্তু এখন নজর দিতে হবে প্রযুক্তিভিত্তিক অন্যান্য খাতের দিকে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন মনে করেন, প্রাথমিক শিক্ষার পরের ধাপে যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তা কী কাজে আসছে, জানা নেই। শিক্ষকদের জবাবদিহি ও শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে পারছে না স্কুল কমিটিগুলো।
ওয়াটারএইডের আঞ্চলিক প্রতিনিধি খায়রুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি পর্যায়ের ব্যর্থতার বিষয়টি করোনার সময়ে নজরে এসেছে। বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে অপারগতা জানালে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল।